করোনার প্রভাবে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বহুমুখী চ্যালেঞ্জে পড়েছে। করোনার প্রভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লকডাউন চলায় চাহিদার পরও পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না।
একই কারণে রফতানিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। একই সঙ্গে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় কিছু অপরিহার্য পণ্যের দাম বেড়েছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও। করোনার কারণে বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দীর্ঘদিন ধরে স্থবির থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।এদিকে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বেশি এমন দেশগুলোতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এখনও পুরোপুরি চালু হয়নি। এতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বাণিজ্য।
এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আমদানি-রফতানি বাণিজ্য এককভাবে কোনো দেশের ওপর নির্ভরশীল নয়। একাধিক দেশ এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে বাংলাদেশের এককভাবে এখানে তেমন কিছু করার নেই। কেননা বাংলাদেশ যেসব দেশে পণ্য রফতানি বা আমদানি করে ওইসব দেশ এখনও করোনার থাবা থেকে মুক্ত হয়নি।
চীনের অধিকাংশ এলাকা স্বাভাবিক হলেও এখন আবার নতুন করে সংক্রমণ ঘটছে। টানা লকডাউনে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। ফলে রফতানির চাহিদা কমেছে। রফতানির চাহিদা কমায় আমদানিও কমে গেছে।এতে আমদানি রফতানি বাড়ানোর ক্ষেত্রে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। যেগুলো বাস্তবায়ন করা কঠিন। এর মধ্যে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আরও বেশি গতি সঞ্চার করতে হবে। আগের সব কর্মসংস্থান সম-পর্যায়ে রেখে আরও নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে, ফলে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে, পর্যটন, চিকিৎসাসহ মানুষের স্বাভাবিক চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই সব খাতের ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙ্গা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, একক দেশ হিসাবে চীনের সঙ্গেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য রয়েছে। এরপরেই আছে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত। অঞ্চল হিসাবে সবচেয়ে বেশি বাণিজ্য হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সঙ্গে। বাংলাদেশের মোট আমদানির ২৬ শতাংশ এবং রফতানির ৩ শতাংশ হয় চীনের সঙ্গে।
মোট রফতানির ২৬ শতাংশ এবং আমদানির সাড়ে ৩ শতাংশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। মোট আমদানির সাড়ে ১৪ শতাংশ ও রফতানির ৩ শতাংশ হয় ভারতের সঙ্গে। মোট রফতানির ৫৬ শতাংশ এবং আমদানির ৮ শতাংশ হয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে। করোনাভাইরাসের কারণে এসব দেশ এখনও পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেনি।
প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের সংক্রমণের কারণে গত জানুয়ারি থেকে চীনের অর্থনীতির চাকার গতি কমে আসে। ফেব্রুয়ারি, মার্চ এবং এপ্রিলের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় একই অবস্থায় থাকে। এরপর থেকে সচল হতে শুরু করলেও এখনও চীনের কোনো কোনো অঞ্চলে করোনার সংক্রমণের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতি ফের আগের অবস্থায় ফিরে আসে।
যুক্তরাষ্ট্রে এখনও করোনার ভয়াল থাবা অব্যাহত রয়েছে। গত মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত দেশটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা চলছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে করোনার প্রকোপ কমলেও এখনও পুরো স্বাভাবিক হয়নি। ৪ থেকে ৫ মাস ধরে এসব দেশে চলা করোনার সংক্রমণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হওয়ায় মানুষের আয় কমে গেছে।
ফলে তারা একেবারে অপরিহার্য পণ্য ছাড়া অন্য কিছু কিনছে না। এতে বাংলাদেশ থেকে ওইসব দেশের পণ্য আমদানির চাহিদা কমে গেছে। এ অঞ্চলে বাংলাদেশ থেকে হিমায়িত খাদ্য ও তৈরি পোশাক রফতানি হয় সবচেয়ে বেশি। সীমিত আকারে কিছু খাদ্যপণ্যের দোকান খোলা থাকলেও পোশাকের দোকান খোলা থাকছে খুবই কম।
.
.
বিক্রি না হওয়ায় গত মার্চ থেকে এ পর্যন্ত বিদেশি ক্রেতারা ৪০০ কোটি ডলারের রফতানির আদেশ বাতিল করেছে। ওই সময়ে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী (যেমন মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ড গ্লাভস ইত্যাদি) ছাড়া অন্যান্য পণ্যের অর্ডার আসেনি বললেই চলে। যে কারণে কিছু গার্মেন্ট চালু থাকলেও অন্যান্য কারখানাগুলো রফতানি করতে পারছে না। ফলে এদের কর্মকাণ্ডও সীমিত হয়ে পড়েছে।
রফতানি আয় দেশে আসতে সময় লাগে ৩ থেকে ৪ মাস। এ হিসাবে গত নভেম্বরে রফতানি করা পণ্যের মূল্য দেশে মার্চে আসা শুরু করে। ওই মাস থেকেই আয় কমতে থাকে। মার্চ-মে কার্যত অচল ছিল বিশ্ব। ফলে ওই সময়ে আয় কমেছে।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের রফতানি আয় বেড়েছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। গত বছরের জুনে রফতানি আয় কমেছিল ৫ দশমিক ২৭ শতাংশ। গত জুনে কমেছে আড়াই শতাংশ। গত বছরের মে মাসে বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৭৮ শতাংশ। চলতি বছরের মে মাসে কমেছে ৬১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। গত বছরের এপ্রিলে রফতানি কমেছিল ২ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
গত এপ্রিলে কমেছে ৮২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। গত বছরের মার্চে বেড়েছিল ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে কমেছে ১৮ দশমিক ২০ শতাংশ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রফতানি বেড়েছিল ১০ দশমিক ১২ শতাংশ। চলতি বছরের একই মাসে কমেছে ১ দশমিক ৮০ শতাংশ। গত বছরের জানুয়ারিতে বেড়েছিল ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে কমেছে ১ দশমিক ৭০ শতাংশ।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের মোট রফতানির ৮৪ শতাংশই তৈরি পোশাক, ৪ শতাংশ পাট ও পাটজাত পণ্য, ৩ শতাংশ চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং ৯ শতাংশ অন্যান্য পণ্য। মোট রফতানিতে যেগুলোর অবদান ১ শতাংশেরও কম। পোশাক ও চামড়া কেনা কমে গেছে। এ দুটিসহ অন্যান্য পণ্যের প্যাকেজিংয়ে ব্যবহৃত হয় পাট। এ দুটির রফতানি কমায় পাটেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
.
.
বাংলাদেশের মোট রফতানির মধ্যে প্রায় ৫৬ শতাংশই যায় ইউরো অঞ্চলের দেশগুলোতে। এর মধ্যে জার্মানিতে ১৬ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১০ শতাংশ, স্পেনে ৬ শতাংশ, ফ্রান্সে ৬ শতাংশ, ইতালিতে ৫ শতাংশ, পোল্যান্ডে ৩ শতাংশ, নেদারল্যান্ডে ৩ শতাংশ, বেলজিয়ামে আড়াই শতাংশ, ডেনমার্কে আড়াই শতাংশ ও অন্যান্য দেশে ২ শতাংশ। টানা লকডাউনের ফলে এসব দেশে রফতানি কমে গেছে।
এছাড়া বাংলাদেশের মোট রফতানির জাপানে ৩ শতাংশ, কানাডায় ৩ শতাংশ, অস্ট্রেলিয়ায় ২ শতাংশ ও অন্যান্য দেশে যাচ্ছে ৬ শতাংশ।
.
.
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্বাভাবিক হলে মানুষ কাজের ধারায় ফিরবে। টানা ৩-৪ মাসের লকডাউনের ক্ষতি পোষাতে হলে আগের চেয়ে বেশি বাড়াতে হবে কর্মসংস্থান ও আয়। তাহলেই কেবল দ্রুত মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়বে। তখন পণ্যের চাহিদা বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে রফতানি। সে পর্যন্ত বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশ শত চেষ্টা করেও রফতানি বাড়াতে পারবে না। আমদানিকারক দেশগুলো স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গতিশীল হলেই রফতানি বাড়ানো সম্ভব। রফতানি বাড়লে আমদানিও বাড়বে।সূত্র জানায়, আমদানি বাণিজ্যেও নেতিবাচক অবস্থা দেখা দিয়েছে। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-মে মাসে আমদানি ব্যয় বেড়েছিল ২ দশমিক ৬২ শতাংশ। সদ্য বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি ব্যয় কমেছে ১০ দশমিক ৮১ শতাংশ। গত বছরের মে মাসে আমদানি ব্যয় কমেছিল ৮ দশমিক ৪৪ শতাংশ। চলতি বছরের একই মাসে কমেছে ৩১ দশমিক ০৪ শতাংশ।
.
.
গত বছরের এপ্রিলে কমেছিল ৬ দশমিক ১০ শতাংশ। এ বছরের একই মাসে কমেছে ৪৪ দশমিক ২০ শতাংশ। গত বছরের মার্চে বেড়েছিল ১ দশমিক ০৭ শতাংশ। চলতি বছরের একই সময়ে কমেছে ১২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ব্যয় বেড়েছিল ৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। চলতি বছরের একই মাসে কমেছে শূন্য দশমিক ৪৩ শতাংশ। গত বছরের জানুয়ারিতে ব্যয় বেড়েছিল ১৬ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এ বছরের জানুয়ারিতে কমেছে ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ।দেশে মোট আমদানির ৬ শতাংশ সিঙ্গাপুর থেকে, ইন্দোনেশিয়া থেকে ৪ শতাংশ, জাপান থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ, আমেরিকা থেকে সাড়ে ৩ শতাংশ, মালয়েশিয়া থেকে ৩ শতাংশ আমদানি হয়।
ব্রাজিল, কোরিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আড়াই শতাংশ করে; জার্মানি, কাতার, সৌদি আরব, তাইওয়ান, থাইল্যান্ড থেকে ২ শতাংশ করে পণ্য আমদানি হয়। কুয়েত, রাশিয়া থেকে দেড় শতাংশ করে, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালি থেকে ১ শতাংশ করে পণ্য আমদানি হয়।মোট আমদানির মধ্যে শিল্পের কাঁচামাল ৩২ শতাংশ, শিল্পের যন্ত্রপাতি ২২ শতাংশ, ভোগ্যপণ্য ৪০ শতাংশ, অন্যান্য ৮ শতাংশ।
.
.
তথ্যসূত্র : যুগান্তর
.
.
.
.